5★
‘আমার মামণির নিকাহ তো এতটুক আয়োজন হবে না?’
আরহাম তাজওয়ার চাচার মলিন মুখ পযবেক্ষণ করে বললেন, ‘সরি।’
বাড়িতে ফিরার পর খাওয়ার পর্ব শেষে মাঝে পর্দা দিয়ে দূজনকে একরুমেই বসতে দেওয়া হলো।তুহফার সাথে চুপচাপ বসে আছে হাফসা।আঙ্গুল দৌঁড়াচ্ছে তসবিহের গুটিতে।আরহাম তাজওয়ার নিজেই উনার সহভাজনদের আক্বদের খেজুর বিলিয়ে দিলেন।পর্দা সরিয়ে এপাশে এসে খেজুরের পাতটা তাদের দিকে এগিয়ে দিলেন সস্নেহে।তুহফা নেওয়ার পর হাফসাও পাত থেকে একটা খেজুর তুললে তিনিও বিসমিল্লাহ বলে একটা মুখে তুলে বেরিয়ে গেলেন।
******
বিদায়ের সন্ধিক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় নিলেই আহমাদের দূ:শ্চিন্তা দূর হবে।কিন্তু ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে যন্ত্রনায়।বেশ কিছুক্ষন হাফসাকে বুকে জড়িয়ে রেখে নি:শব্দে অশ্রু বিসর্জন দিলেন।ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন।হাফসার ভেতরটা যেনো ছিঁড়েফেড়ে যাচ্ছে কষ্টে।আজ মা-বাবার অনুপস্থিতিটা খুব করে অনুভব করছে।খুব কষ্ট লাগছে।কাছের মানুষকে ছেড়ে যাবার মতো অসহ্য অনুভূতির স্বীকার হচ্ছে।বাবা-মেয়ের মর্মান্তিক অনুভূতির আলাপন শেষ হতে হাফসা মামুণীকেও জড়িয়ে কাঁদলো কিছুক্ষণ।
আহমাদ আরহাম তাজওয়ার এর হাত ধরে অনুরোধিত সুরে বললেন, ‘জানিনা ওর ভাগ্যে কী আছে।আমি তোমাকে বিশ্বাস করি আরহাম।ভরসা করি।তোমাকে একটা পবিএ ফুল তুলে দিয়েছি।যাকে কেউ কখনো স্পর্শ করা তো দূরের কথা কোনো পরপুরুষ দেখেনি পর্যন্ত।আমার মেয়েটাকে কষ্ট দিও না।আমি ছাড়া আপন কেউ নেই ওর।কখনো যদি ও না বুঝে ভুল করে ফেলে দয়া করে বুঝিয়ে দিও।তবুও এমন কথা বলো না যেন সে কষ্ট পায়।ওকে যদি তুমি কখনো বোঝা মনে করো দোহাই লাগে আমার মেয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে যেও।তবুও কঠোর হইও না।’
আরহাম তাজওয়ার আহমেদের কান্না থামাতে বুকে জড়িয়ে নিলেন।বিনয়ের সুরে বললেন, ‘আপনার আমানত নিলাম।ইনশাআল্লাহ ভালো থাকবেন উনি।কষ্ট দিবো না।আপনি চিন্তা করবেন না।শুধু দোয়া করবেন।’
হৃদয়বিদারক বিদায়ের ক্ষণ শেষে এবার ফেরার পালা।পর্দাআবৃত হাফসার কপালে চুমু দিয়ে গাড়িতে তুলে দিলেন আহমাদ।আরহামও বিদায় নিয়ে উঠে পাশে বসলেন।গাড়ি চললো জীবনের নতুন এক যাএার উদ্দেশ্যে।যেখানে হাফসার সুখ,দূ:খ,সুসময়,দূ:সময় সব মেনে,মানিয়ে নিতে হবে।পাশের মানুষটা ভালো থাকলে,ওর জীবনের কঠিনমুহুর্তের যাএাও হবে সহজ,সুন্দর।কিন্তু খারাপ হলে,দূনিয়াটাই জাহান্নাম হয়ে যাবে।
*******
সাঁই সাঁই শব্দ তুলে পঁচিশ মিনিট ধরে আঁকাবাকা পথে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে।দূজনে চুপচাপ বসে আছে।উনার কথামতো হঠাৎ সাইড ঘেষে গাড়ি থেমে গেলো।মাঝখানের একহাতের দূরত্ব গুছিয়ে আরহাম পাশে এসে বললেন,
(৯)
‘আপনি একটু বেরোবেন প্লিজ।’
হাফসা চমকে তাকালো।লোকটা কি বের করে দিবেন আমায়? এই মাঝ রাস্তায়?
হাফসা চোখের পর্দা উঠিয়ে উনার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো।আরহাম একজোড়া টকটকে লাল ভিজে জবজবে চোখ দেখলেন।মায়া হলো উনার।
‘কেন বের হবো?আপনি আমাকে মাঝরাস্তায় রেখে যাবেন তাইনা?অতঃপর ভেটু ভেঙে কেঁদে বলে, ‘আমি বাড়ি যাব।’
আরহাম বোকা বনে গেলেন কিছুক্ষণের জন্য।নিষ্পলক চেয়ে রইলেন ওর ভয়ার্ত চোখের দিকে।ধ্যান ভাঙ্গতেই হাফসার মুখোমুখি হয়ে বললেন, ‘ভুল ভাবছেন।আমি কেন বের করবো আপনাকে?ফেলে যাবো কেন?’
‘এখুনি না বললেন বের হতে।’
‘লুক এহেড।’
হাফসা কথামতো সামনে তাকাতে দেখলো লাল টকটকে তাজা গোলাপ দিয়ে একইরকম আরেকটা গাড়ি সাজানো।
উনি শান্তসুরে বললেন, ‘কান্না বন্ধ করুন।আমি আপনাকে বিয়ে করেছি।আমার বাড়িতেই নিয়ে যাবো।আর বলতে চাইছিলাম আপনার ইচ্ছা থাকলে সামনের গাড়িতে যেতে পারি আমরা।বিয়েটা অল্প পরিসরে হচ্ছে।সেফটির জন্য গাড়ি সাজানো হয়নি।তাই ভাবলাম আপনার ব্যাক্তিগত শখ থাকতে পারে।থাক আপনাকে বের হতে হবে না।ভুল বুঝবেন না।’
হাফসা এবার বুঝতে পারলো।কি লজ্জা!কি বোকামি টাই না করেছে!
উনি যেই ড্রাইভারকে আবার গাড়ি স্টার্ট দিতে বলবেন অমনি হাফসা বলে ওঠে, ‘সামনের গাড়িটায় যাবো।’
উনি শান্ত চাহনি দিলেন।অতপর গাড়ির দরজা খুলে বের হলেন।হাফসার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিতেই হাফসার কাঁপুনি বেড়ে গেলো।
‘প্ পা পারবো একা।’
উনি মুচকি হেসে হাত সরিয়ে নিলেন।বলা বাহুল্য, উনি হাফসার কাঁপাকাঁপির অবস্থা বুঝতে পারছেন।
দূজনে গাড়িতে উঠতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো।হাফসার গুটিয়ে যাওয়ার অবস্থা বুঝেই উনি সরে বসছেন।
এসি চালু করতেই গোলাপের মৌ মৌ সুবাস ছড়িয়ে পড়লো আরও বেশী।সাথে পাশে উনার থেকে খুব সুন্দর একটা আঁতরের সুগন্ধি নাকে আসছে।সব মিলিয়ে সুন্দর একটা মুহুর্ত।উনি পাগড়ি খুলে রাখলেন।হাফসা আড়চোখে একবার তাকাতে চমকালো।এখন আরো বেশী মায়া লাগছে।সাদা কপালে কালো চুলের বাহার।
পথ প্রায় দূ ঘন্টারও অধিক জার্নি।বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকতেই দূচোখ ভরে ঘুম এসে ভর করলো হাফসার।সারারাত মোনাজাতে অশ্রু জড়াতে ব্যস্ত থাকা নির্ঘুম চোখে যেন ঘুম জেঁকে বসলো।সিটে মাথা হেলান দিয়েও শান্তি হলো না।আঁকাবাঁকা রোডে গাড়ির ঝাঁকুনিতে বারবার হেলেদূলে পড়ছে।
চোখদূটি লেগে আসছিলো কিছুক্ষণের মধ্যে।উনি উনার মতো বসে রয়েছেন চুপচাপ।হঠাৎ ঘুমের মধ্যে গাড়ির গ্লাসে হেলে পড়ায় মাথায় বাড়ি খেতেই ব্যথা অনুভব করলো।
উনি সাথে সাথে এগিয়ে এসে একহাত সিটের পেছন দিকে নিয়ে হাফসার মাথা তুলে ধরলেন।ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ব্যাথা পেয়েছেন?’
হাফসা ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘হুম।’
এরপরে ওর আর কিছুই মনে নেই।মাথায় যেখান ব্যথা পেয়েছে সেখানে মাসাজ করতে করতে উনি কাছাকাছি বসে ওকে বুকের একপাশে পরমযত্নে আগলে নিলেন।মনে মনে আওড়ালেন, ‘আপনাকে পাওয়ার মতো এতো সৌভাগ্য ছিলো আমার!নাউ আই ক্যান এক্সপ্লেইন , হাউ মাচ লাকি আই এম।’
*******
(৯)
প্রায় দেড় ঘন্টা পর…
‘উমায়ের শুনছেন!’
কয়েকবার কারো মুখে নিজের নাম শুনে আধো আধো চোখ মেলে তাকালো হাফসা।কোথায় আছে বুঝতে চোখতুলতে দেখলো সে প্রাণঘাতী লোকটার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে ছিলো এতক্ষণ।আবার একহাত উনার বুকে রাখা দেখে হাফসা তড়িৎ হাত গুটিয়ে নিলো।
ঘুমের মধ্যে উনাকে জড়িয়ে ধরেছিলো ভাবতেই গা শিউরে ওঠলো ওর।উনি ওর চমকানো দেখে ঠোঁট কামড়েে হাসলেন।
হাফসা নিজের অবস্থান বুঝতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো বড়সড় দ্বিতল আলিশান ভবনের মধ্যকার প্রশস্ত উঠানে গাড়ি থেমেছে।ফুলে রাঙ্গা আকর্ষণীয় তিনটা বড় বড় বারান্দা নজর কাড়ছে সবার আগেই।দিনের বেলাও সাদা রঙ্গের বাতিতে ঝলমল করছে বাড়িটা।ইউনিক স্টাইলের ফরেন হোমসের মতো বাড়িটা যেন চারপাশে একটা জীবন্ত বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।
উনি একটু সরে বসে বললেন, ‘বেরোতে হবে।এসে গেছি।’
হাফসা না বুঝে জিজ্ঞেস করলো, ‘হু?’
‘বাড়িতে এসে গেছি।ভেতরে যেতে হবে।’
আশপাশে তাকাতে নিলেই কাঁচ ভেদ করে একজন মহিলাকে দেখতে পায়।যিনি হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন এদিকটাতেই!
আরহাম বের হয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিতেই ওই মহিলা হাফসাকে হাতে ধরে বের করলেন।হাফসা হা করে তাকিয়ে আছে উনার দিকে।সাদা পোশাকে আবৃত থাকায় তাঁর সৌন্দর্য যেন বয়স ভেদ করছে।
‘আসসালামু আলাইকুম।’
হাফসার সাথে হাসিমুখে সালাম বিনিময় শেষে তিনি লোকটার চুল খামচে ধরে মাথা নামিয়ে এনে কপালে চুমু দিলেন।আরহাম তাজওয়ারের সাথে সাক্ষাৎকালে এই প্রথম প্রাণখুলে উনাকে হাসতে দেখা গেলো!ইসস.. কি সুন্দর!চোখ মাতানো হাসি!
বাড়ির ভেতরে এসে রাজকীয় অবস্থায় চোখ বুলিয়ে নিতেই আরহাম সুদর্শী মহিলাকে ইশারা করে হাফসাকে বললেন, ‘আমার আম্মু।’
আম্মু মিষ্টি হেসে দৃষ্টি বিনিময় করে হাফসাকে সোফায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোমার পুরো নাম কি?’
‘উমায়ের মুসতাকিম হাফসা।’
নামটা বহুবার আরহামের মুখে শুনে থাকলেও হাফসার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হলো।
মুচকি হেসে বললেন, ‘মাশাআল্লাহ সুন্দর নাম।আমাকে চিনেছো তো?’
হাফসা ঢক গিলে বলল, ‘জ্বী।’
‘কে বলোতো?’
হাফসা সামনে আরহামকে দেখিয়ে বলল, ‘উ্ উ্ উনার আম্মু।’
ওর এমন কাঁপা কন্ঠ শুনে দূজনেই হেসে ফেললেন।
আম্মু ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমি অনেক ছোট।নার্ভাস ফিল করছো বুঝতে পারছি।আমিও তোমার আম্মু এখন থেকে। তুমি আমার বউমা নও।আমার মেয়ে’ই।ঠিকাছে?’
হাফসা ছলছল নয়নে মাথা নাড়ালো।
আম্মু কিছুক্ষণ ওর নিকাবে ঢাকা মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরহাম কখনো তোমার ফেইস দেখেছে?’
হাফসা দ্বিধায় পড়ে গেলো কি উত্তর দিবে।ওর জানামতো তো দেখেননি।তাহলে কি না বলবে?
আম্মু ওর ভয়ার্ত অবস্থা বুঝে আরহামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেখো তো নি তো ওকে তাই না?’
তিনি মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দিলেন।
‘চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে পরির মতো হবে।এখানে খুলতে পারি তোমার নিকাব?দেখতে পারি তোমাকে?’হাফসাকে জিজ্ঞেস করলে,
লোকটা উত্তর দিলেন, ‘আপনার রুমে নিয়ে যান আম্মু।’
‘তুমি আগে দেখো।’
আরহাম তাজওয়ার মাথা নাড়ালেন।মানে উনি আগে দেখবেন না।আম্মুই আগে দেখতে হবে।
আম্মু মুচকি হেসে মিষ্টিমুখ করিয়ে হাফসাকে উপরে নিয়ে গেলেন।সিঁড়ি বেয়ে উঠতে বেশ বেগ পেতে হলো হাফসার।রাজস্থানি ভারি ল্যাহেঙ্গা আর অর্নামেন্টসে শরীরের ভার যেনো বেড়ে গেছে দ্বিগুণ।
দোতলায় রুমে নিয়ে পারমিশন নিয়েই বোরকা খুলে দিলেন।আম্মু নিকাব খুলে চেহারা দেখতেই চোখে মুখে চুমু খেয়ে পুনরায় মুখ ঢেকে আরহামের রুমে নিয়ে আসলেন।আরহাম তাজওয়ার বেলকনিতেই অপেক্ষা করছিলেন।
ফুল সাজানো বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আম্মু রুম ত্যাগ করলে উনি রুমে আসলেন।ওকে আপাদমস্তক দর্শন করলেন।
এখন বউ বোঝা যাচ্ছে।খয়েরী ল্যাহেঙ্গায় অলংকার ভর্তি শরীর।
হাফসা নিচুমুখে বসে আছে।হৃৎস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে। হৃদয়টা লাফাচ্ছে জোরে জোরে।এমন অনুভূতি হচ্ছে কেন?
নীরবতা ভেঙ্গে তিনি বললেন, ‘দেখতে পারি আপনাকে?”
6★
হাফসা নিচুমুখে বসে আছে।হৃৎস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে, হৃদয়টা লাফাচ্ছে জোরে জোরে।এমন অনুভূতি হচ্ছে কেন?’
নীরবতা ভেঙ্গে তিনি বললেন, ‘দেখতে পারি আপনাকে?’
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই তিনি কাছে এগিয়ে আসলেন।
নিকাব খুলতে চেয়েও কেন জানি পিছিয়ে গেলেন আবার।হাফসা জিজ্ঞাসাদৃষ্টি তুলতেই উনি বললেন,
‘আপনি খুলুন।’
হাফসা কিছুক্ষণ নিরুত্তর থাকলে আরহাম তাজওয়ার ওর জড়ো করা কেঁপে উঠা হাতের দিকে তাকালেন।মুচকি হেসে ওর সামনে এসে মাথার পিছনের গিট খুলে দিলে নিকাব আলগা হয়ে যায়।
ছোট্ট নিকাবখানা উনার হাতে।হাফসার চেহারা দৃশ্যমান হতেই উনি চমকে যান।মায়াবী দৃষ্টিতে তাঁর মুখাবয়ব পরখ করতেই আপনাআপনি মুখ থেকে বেরোয়, ‘মাশা-আল্লাহ!’
আরহাম পলকহীন দেখছেন তাকে।একটা মানুষ এত নিঁখুত সুন্দর কী করে হতে পারে!
আরহাম তাজওয়ার হেসে ফেললেন।অত্যন্ত সুন্দর সম্বোধনে বললেন, ‘ইউ আর সো বিউটিফুল, লাইক অ্যা ফ্লাওয়ার!’
হাফসা চমকে ভীরু চোখে উনার দিকে তাকালো।
উনি ওর সামনাসামনি বসে বললেন, ‘নিকাহ’র আগে আমি আপনাকে দেখতে চাইনি।ইচ্ছে করেই চাইনি।কারন আমি আপনার আখলাক শুনে আপনাকে পছন্দ করেছি।সৌন্দর্য দেখে নয়।আমার কাছে সৌন্দর্যের চেয়ে দ্বীনদারিতার প্রায়োরিটি বেশী।আমি চেয়েছি আল্লাহর একজন ভীরু আর গাঢ় তাওয়াক্কুল ওয়ালা কেউ আমার ঘরে আসুক।আমার পরিবারটাকে আরও স্ট্রং দ্বীনদার বানাতে সাহায্য করুক,আর আমাকেও।’
হাফসা এখনো চুপ।কেনজানি ওর বুকটা ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রনায়।দম বন্ধ হয়ে আসছে।শরীর কাঁপছে ভীষণ ভাবে।দীর্ঘ হয়ে বেরিয়ে আসা শ্বাসগুলো যেন আটকে যাচ্ছে গলায়।
‘আপনি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করুন।আপনি না চাইলে আমি কোনো অধিকার খাটাবো না।দূরে থাকবো। ভয় পাবেন না আমাকে।’
হাফসার অস্বস্তি বাড়তে লাগলো।আরহামের সব কথাই ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।কোনো ভাষা, কোনো শব্দ, কোনো অর্থই ওর বোধগম্য হচ্ছে না।মাথাটা কেমন ঘুরছে।
আরহাম ওর নরম তুলতুলে শুভ্র হাতখানার দিকে তাকাতেই দেখলেন এক হাত দিয়ে আরেক হাত খামচে ধরে রেখেছেন।ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছেই।চোখমুখ হঠাৎ করেই লাল দেখাচ্ছে।
আরহাম তাজওয়ার নিজের অবস্থান দেখে সরে বসলেন।সে হয়তো নার্ভাস ফিল করছে।
হাফসার গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে।শক্তিটা যেন কমে আসছে ক্রমশ।একটু সামনেই পিওর পানির বোতল দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ায় পানি খাওয়ার জন্য।তখুনি মাথা ঘূর্ণি দিয়ে ওঠতেই দূহাতে মাথা চেপে ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিলেই তিনি দ্রুত এসে ধরে নিলেন।নাম ধরে ডাকলেন কয়েকবার।হাফসার আর কিছুই মনে নেই।তবে চোখ বন্ধ করার আগে কর্ণকুহরে আরহামের উঁচু আওয়াজ শোনা গেল। ‘আম্মু আম্মু!’
(১০)
ঘন্টা দূয়েক পর…
হাফসা ঘুম ভাঙ্গতেই দেখে অন্ধকার রুম।ড্রীম লাইটে চারপাশ আধো আলোয় দৃশ্যমান।উঠতে গেলেই নিজেকে খুব ভারী মনে হয়।হাফসার নড়াচড়া পেয়ে তিনি লাইট অন করলেন।হাফসা চোখ কুঁচকে তাকালো লাইটের তীব্র আলোয়।নিজেকে আপাদমস্তক দর্শন করে দেখলো এখনো আগের অবস্থায়’ই আছে।সাজসজ্জা,ভারী ল্যাহেঙ্গা!
উনার পরনে একটা সাদা শার্ট আর আ্যশ কালার প্যান্ট।হাফসাকে উঠতে দেখে উনি এগিয়ে এসে বললেন,
‘আমি আপনার মাথায় হাত দিচ্ছি, নড়াচড়া করবেন না।’
বলে উনি ওর মাথায় হাত দিলেন।নাহ মাথার টেম্পারেচার তো ঠিক আছে।
উনি একটা চেয়ার এনে হাফসার থেকে দূরে বসে শান্তকন্ঠে বললেন,
‘কেমন লাগছে?ঠিক আছেন আপনি?’
‘ক্ ক্ কেন?কি হয়েছিল আমার?’
‘সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলেন।’
মস্তিষ্ক ঘাটতেই মনে হলো আগের ঘটনা।বলল, ‘মনে পড়েছে।’
‘আপনার কি খারাপ লাগছে?’
হাফসা মাথা নাড়ায়।
উনি এবার নরম সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি আমাকে ভয় পান?কেন?’
হাফসা হঠাৎ করেই কেঁদে দিয়ে বলল, ‘আমাকে বাড়ি দিয়ে আসুন।আমার কষ্ট হচ্ছে, বাড়ি যাব।’
হাফসার আচমকা কান্না দেখে উনি দাঁড়িয়ে গেলেন।তখুনি দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও আম্মু পারমিশন নিয়ে এসেই কান্নারত হাফসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কি হয়েছে আমার মেয়েটার?কাঁদছো কেন তুমি?’
আদূরে সম্বোধন পেয়ে হাফসার কান্নার বেগ যেনো আরো বেড়ে গেলো।হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল, ‘আমি বাড়ি যাব।মামুণীর কাছে যাব।কাকা মণির কাছে যাব।’
তিনি যত্ন করে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই যাবে।যখন মনে চায় যাবে।কিন্তু কাঁদছো কেন?আরহাম কি তুমায় কিছু বলেছে?’
হাফসা মায়ের বুক থেকে হালকা উঁকি মেরে দেখলো লোকটাকে।অসহায় চাহনীতে চেয়ে আছেন ওর দিকে।
‘বলো!ও কিছু বলেছে তুমাকে?ঝাড়ি দিয়েছে?’
‘জ্বী না।’
‘আচ্ছাহ!তাহলে কান্না করছো কেন?বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে?’
‘হুমম।’
‘তাই?আচ্ছা কান্না বন্ধ করো।তুমার কাকামণি আসবে তুমাকে দেখতে।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ সত্যি।’
‘এখন কান্না বন্ধ করো।আচ্ছা আগে কেন সেন্সলেস হয়েছিলে?ভয় পেয়েছিলে?’
হাফসা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়তেই তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
‘খিদে লেগেছে তুমার?’
‘জ্বি।’
‘ড্রেস চেন্জ করে ফ্রেশ হয়ে খাবে না এখন খাবে?
‘খিদে লেগেছে।’
‘আচ্ছা একটু অপেক্ষা করো।আমি নিয়ে আসছি খাবার।’
আম্মু চলে গেলে হাফসা হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে উনার দিকে তাকাতেই তিনি চোখ সরিয়ে নেন।
‘আফওয়ান।ভয় পাইয়ে দিয়েছিলাম আপনাদের।'(হাফসা)
‘ভয়টা কি আমার জন্য পেয়েছিলেন?’
আরহামের বিড়বিড় করা কথাটা বুঝলো না হাফসা।
হু?’
‘বলছি ভয় পাবেন না।আমি কি চলে যাব?আম্মুর সাথে থাকুন?’
আম্মু আসতে তিনি বেরিয়ে গেলেন।আম্মু খাবার মেখে মুখে তুলে দিতে চাইলে হাফসা জিজ্ঞেস করে, ‘আপনারা খেয়েছেন?’
‘পরে খাব।তুমি খেয়ে নাও।’
‘আপনাদের রেখে….’
‘উহু, তুমি সকালে কি না কি খেয়েছো।তুমার তো খিদে লাগার কথা।খেয়ে নাও।’
উনার হাতে খেয়ে তৃপ্তি অনুভব করলো হাফসা।খাওয়ানো শেষে আম্মু চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর লোকটা রুমে আসলেন।
‘খাওয়া শেষ?’
‘হুমম।’
‘আপনার অস্বস্তি হচ্ছে নিশ্চয়ই।ড্রেস চেন্জ করে নিন।’
‘হ্যাঁ না ম্ মানে না ক্ করব না।’
‘কেন?’
অতপর হাফসার নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার অবস্থা দেখে বললেন, ‘আমি বাইরে যাচ্ছি।আম্মু আপনাকে হেল্প করবেন।’
‘আচ্ছা।’
তিনি বেরিয়ে গেলে আম্মু এসে সব অর্নামেন্টস খুলতে হেল্প করে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিতে বললেন।
প্রায় আধঘন্টা পর হাফসা ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হলো।তিনি রুমে আসলেন টুপি নেওয়ার জন্য।এক্ষুণি আসরের আযান দিবে।
হাফসা একটা ঢিলেঢালা পোষাক পড়েছে।মাথায় হিজাব বাঁধা।মেহেদী,সোনালি আর কালোর মিশ্রণের পোশাকটিতে হাফসাকে দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকালেন আরহাম।মেকাপ সরিয়ে ফেলায় আরো আরো বেশী মায়া লাগছে।যেনো কৃত্রিম প্রসাধনী দিয়ে মুখের নৈসর্গিক আসল সৌন্দর্য ডেকে রাখা হয়েছিলো।
আরহাম দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতে বললেন, ‘মাশাআল্লাহ! আপনাকে এত….’
হাফসার সেন্সলেস হওয়ার ঘটনা মনে পড়তেই অর্ধেক কথাতে’ই থেমে গেলেন আরহাম।কাবার্ড থেকে টুপিটা মাথায় তুলে বললেন, ‘ওইযে নামাজের আলাদা রুম।কিছু প্রয়োজন হলে আম্মুকে বলবেন।আসি।’
‘কোথায়.. ?’
‘মসজিদে।’
উনি চলে গেলে হাফসা বেলকনিতে বের হলো।বেলী ফুলের সুগন্ধি নাকে এসে লাগতেই প্রাণভরে নি:শ্বাস নিলো কয়েকবার।মনে মনে আওড়ালো পুুরুষ মানুষও এত শৌখিন হয়!
(📌গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।এটাকে বাস্তবের সাথে মিলাবেন না কেউ।)