প্রতিদিন দুচারটে চড় না খেলে তার পেটের ভাত হজম হয় না তাও মায়ের হাতের। মুখে আঁচল দিয়ে কাঁশতে কাঁশতে মালা বলল,’কতবার কইছি মুখে মুখে তর্ক করবি না। তোর ছোট আম্মা হয়।’
বড়সড় ঘোমটা টেনে বৈঠক ঘরে এলেন মালা। সাথে একটু আগে আসা মেয়েটি ও। মালা নিচু স্বরে বললেন,’কুসুম হেগোরে নাস্তা পানি দে।’
‘পরী আমাগো জমিদারের ছোট মাইয়া। আপনারা পরীগো বাড়িতেই গেছেন। পরীর মা বাপে অনেক শাসন করে ওরে। সবসময় ঘরের ভিতরে বইসা থাকে বাড়ি থেকে বাইর হয় না একটুও।’ মনোযোগ দিয়ে সম্পানের কথাগুলো শুনলো নাঈম তারপর বলল,’কেমন দেখতে পরী? তুমি কি কখনো ওকে দেখেছো?’ হাসলো সম্পান। হাত নাড়িয়ে বলল,’আমি ক্যান বাবু এই গাঁয়ের কোন বেডা মাইনষেও পরীরে দেহে নাই। আমি দেখমু কেমনে?’
নাঈমের চোখদুটো খুশিতে চকচক করছে পরীকে দেখে। এতক্ষণ ধরে মেয়েটার মধুর বানি শুনছিল সে। গলার স্বর টা সত্যি খুব সুন্দর। এখনও কানে বাজতেছে। কথা শুনে এখন পরীকে দেখার ইচ্ছা আরো প্রবল হচ্ছে। তবে পরীর কথাগুলো বেশি মুগ্ধ করেছে ওদের।
পরীর জন্ম যেন সবার কাল হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে একটা ছেলেই জন্ম দিতে পারেনি মালা যেখানে রূপবতী মেয়ের জন্ম দিয়ে কি হবে?রূপ যেন অভিশাপ এনে দিয়েছে মালা ও তার মেয়েদের জীবনে।
‘পাগল নাকি কিছু কমু! আমার মনে হয় হেয় আমার কথা বিশ্বাস করে নাই। পরীরে হেয় দেখতে চায়।’ ‘কও কি?এই কথা তো পরীরে জানাইতে হইবো। পরী জানলে কি করব কে জানে?’
বিন্দু হুড়মুড়িয়ে উঠে বাইরে এলো সম্পানকে কথা শেষ করতে না দিয়েই জোরে বলল, ‘তোমারে না কইছি এমন কথা কইবা না? তারপরও ক্যান এমন কথা কও বারবার?আর মরার কথা কইবা না কইয়া দিলাম।’
পরী চুপ থেকে কথাগুলো শুনলো। ফিরে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়ালো বলল,’পাহারা বাড়ায়ে দেন। অন্দরে কেউ ঢুকেছিল। ভাগ্য ভালো আমার হাতে পড়ে নাই।’
ঘাড় ঘুরিয়ে রুমির দিকে তাকালো পালক। রুমি ঠোঁট টিপে হাসছে। তারমানে রুমি কিছুটা বুঝেছে। শায়েরের দিকে তাকিয়েই পালক বলল,’ভালো লাগাটা ধর্ম দেখে হয় না,মানুষ দেখে হয়।’ ‘বুঝি না এই গ্রামে এসে সবার হলো কি?নাঈম, শেখর,আসিফ তুই!!তবে তোর কথাটা আলাদা। এটা সম্ভব না।’
‘আপনার কি মনে হয়?মানে কাজটা কে করতে পারে?’ ‘আমার মনে হয় বিপক্ষ দল একাজ করেছে। আর নয়তো আপনার উপর কারো ক্ষোভ ছিল। আপনার সাথে কি কারো মনোমালিন্য হয়েছিল?’ নাঈম মাথা নেড়ে না বলল। ‘তাহলে বুঝতে পারছি না। বন্যার কারনে লোকজন ও লাগাতে পারছি না।’
মিষ্টি আর রুমি আসতেই পালক উঠে দাঁড়াল। পরীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,’ফিরে এসে তোমার সাথে অনেক গল্প করব পরী।’ জবাবে পরী মাথা দোলায় শুধু। ওরা চলে যেতেই জুম্মান হেসে বলে,’এই আপা অনেক ভালো তাই না আপা?’
নাঈমরা নিজেদের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে। পালক কে নিয়ে এখনই শহরে রওনা হবে সবাই। পালকের বাবা মা শহরে থাকেন। ওখানেই দাহ করা হবে পালককে।কোন মুখে ওরা পালকের বাবা মায়ের সামনে দাঁড়াবে তাই ভেবে পাচ্ছে না ওরা।
মালা কুসুম আর জেসমিন খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। খাওয়ার মাঝে কবিরই প্রথম কথা তুলল পরীর বিষয়ে। আফতাব কে উদ্দেশ্য করে বলল,’আব্বা আমার একটা কথা আছে।’ -‘কি কথা??’ -‘নওশাদ খুবই ভাল ছেলে। শহরে বড় ব্যবসা করে। তাই আমি একখান প্রস্তাব আনছি। যদি পরীর সাথে ওর বিয়ে দেন তো পরী ভালো থাকবে।’
-‘আল্লাহ আপনে জানেন না?মেজো আপার দেওরের লগে আপনার বিয়া ঠিক। আহা কি সুন্দর পোলাডা। আপনের লগে অনেক মানাইবো।’ পরী চট করে দাঁড়িয়ে গেল।
নওশাদ এগিয়ে নিজেও খুজতে লাগল। কুসুম জুম্মান কে চোখ মেরে বলল,’পরী আপার কত শখের নূপুর টা। যে পাইয়া দিব তারে পরী আপা মনে হয় পুরস্কার দিবো। চল জুম্মান ভাল কইরা খুঁজি।’
-‘তোর সাহস তো কম না আমাকে শাসাস!!ভয় দেখাস আমাকে??সেদিনের পুচকে মেয়ে। জীব টেনে ছিড়ে ফেলব তোর বাপ ও কিছু বলবে না।’ -‘পরীর কলিজায় হাত দেবেন এতো বড় কলিজা আপনার??ওই কলিজায় তলোয়ার চালাতে পরীর হাত কাঁপবে না। সাবধান,আপনাকে কিন্ত পরী ছেড়ে দিবে না।’
মালা যে শায়ের কে খাইয়ে দিয়েছে তা পরীর কানে যেতে সময় লাগলো না। পরীর চামচা কুসুম গিয়ে বলে,’জানেন পরী আপা বড় মায় শায়ের ভাইরে খাওয়াইয়া দিছে আইজ। ভাইয়ের হাত নাকি পুইড়া গেছে। আমি নিজের চক্ষে দেইখা আইলাম।’
কিন্ত আজ তারা তিনজনই ছুটে এসেছে পরীকে দেখতে। কারণ এতোদিন ধরে তারা শুধু পরীর সুনামই শুনেছে কিন্ত চোখের দেখা দেখেনি। রুপালির বিয়ের পর এই প্রথম পরী এই বাড়িতে পা রাখলো। তাই ওনারা তিনজন ছুটে এলে পরীকে দেখতে।
আফতাবের আগেই পরী এগিয়ে এসে জবাব দিল,’আপনার ভাইকে জবান সামলে কথা বলতে বলুন আব্বা। না জেনে ওনাকে কেন দোষ দিচ্ছেন? দোষ তো আপনাদের। কথা দিয়ে কথা রাখেননি আপনারা যার জন্য আমাদের বিপদে পড়তে হয়েছে। আর উনি না থাকলে আমাদের বেঁচে ফেরা সম্ভব হত না।’
আফতাব এবার কড়া চোখে মালার দিকে তাকিয়ে বলে,’পাগল হয়ে গেছে তোমার মেয়ে। সামলাও মেয়েকে।’ বলেই আফতাব অন্দর ছেড়ে চলে গেলেন। মালা পরীর গালে পরপর কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে ওর ঘরে আটকে রাখলো।